একজন শিক্ষার্থী কখন সাহিত্য পড়বে আর কখন গণিত পড়বে, কখন বিজ্ঞানের জ্ঞান লাভ করবে, কখন রাজনীতি চর্চা করবে, কে শিল্পকলা চর্চা করবে, কখন করবে, প্রযুক্তিগত জ্ঞানে আমরা কী লক্ষ্য অর্জন করতে চাই, নৈতিকতা গঠন কিভাবে হবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে শিক্ষাব্যবস্থাকে সুবিন্যস্ত আকারে সাজানো জাতিগঠনের শিক্ষা।
জাতি গঠনের শিক্ষা
জাতি গঠনের শিক্ষা যে কী, তা বোঝার জন্য বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক প্লেটোর শিক্ষাদর্শন যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তা হলে দেখব, তিনি শিক্ষাকে শিক্ষার্থীর বয়স অনুযায়ী তিনটি পর্বে ভাগ করেছেন। প্রথম স্তরে অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায় একজন শিক্ষার্থীর মনস্তত্ত্ব গঠনের সময়। দ্বিতীয় স্তরে বা মাধ্যমিক পর্যায়ে হবে বুদ্ধি গঠন এবং তৃতীয় অর্থাৎ উচ্চ শিক্ষার স্তরে হবে জ্ঞানার্জন। মনস্তত্ত¡ গঠনের পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীকে শোনানো হবে গল্প ও সঙ্গীত আর শেখানো হবে সাহিত্য ও শিল্পকলা, যা তার মধ্যে সৎ সাহস, গাম্ভীর্য ও সংযম তৈরি করবে, যাতে আত্মার সাথে মানবিকতার মিলন ঘটার মাধ্যমে মানবিক ও মননশীল মনোভাব গড়ে ওঠে। পরবর্তী পর্যায় হলো বুদ্ধিবৃত্তি গঠনের পর্যায়। এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীকে তার চিন্তাশক্তির চরম শিখরে পৌঁছানো এবং বুদ্ধির জগতে প্রবেশ করানোর জন্য শিখতে হবে গণিতশাস্ত্র, বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান। তৃতীয় স্তর হলো জ্ঞানার্জনের স্তর। এই স্তরে শিক্ষার্থীকে দার্শনিক শিক্ষায় নিযুক্ত করতে হবে, যাতে সে শিক্ষার মূল নির্যাস ‘জ্ঞান’ অর্জন করতে পারে। শিক্ষার এই দর্শন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রাথমিক স্তরে গণিত ও বিজ্ঞান শেখানোর ধারণা সঠিক নয়। তবে গণিত ও বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেয়ার প্রয়োজন মনে হলে সেটিও ওই গল্প ও সঙ্গীতের মাধ্যমে হতে পারে।
চিন্তাধারায় দার্শনিক মনোভাব
চিন্তাধারায় দার্শনিক মনোভাব না থাকলে ভোগবাদ ও বস্তুবাদের প্রবেশ ঘটতে পারে। ভোগবাদী ও বস্তুবাদী চিন্তাধারায় আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়ায় এবং গণমুখী চিন্তাধারা গঠনে বাধা দেয়। তাই গণমুখী, সময়োপযোগী, বুদ্ধিবৃত্তিক তথা সমৃদ্ধ চিন্তাধারা গঠনে নিরপেক্ষ ও নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সুযোগ থাকা চাই। চাপিয়ে দেয়া কোনো ভাবধারায় চিন্তা করতে বলা হলে সঠিক চিন্তাধারা গঠিত হয় না। চিন্তা গঠনের ক্ষেত্রে দেশ, দেশের মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশ, জাতীয়তা প্রভৃতি বিষয় সামনে রাখতে হয়। আর এটিও স্বতঃসিদ্ধ যে, একটি জাতিরাষ্ট্র আর একটি বহুজাতিক রাষ্ট্রের চিন্তাধারা এক রকম হতে পারে না। বাংলাদেশে বসে আমেরিকার মানুষ ও সমাজব্যবস্থাকে সামনে নিয়ে শিক্ষাভাবনা গড়লে সেটি সঠিক হবে না। কারণ বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র আর আমেরিকা বহুজাতিক রাষ্ট্র। এ ছাড়া জাতি গঠনের শিক্ষা নিয়ে ভাবতে গেলে পরিবর্তনের ধারাটাও মনে রাখতে হবে। আগামী ৫০-১০০ বছরে সমাজে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। সবার ওপর নৈতিকতা। নৈতিকতা ছাড়া সব কিছুই অর্থহীন। তাই শিক্ষার মাধ্যমে জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় নৈতিকতার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা দরকার।
জীবনধারা গঠন
জাতি গঠনের ক্ষেত্রে এর পরের বিষয়টি হলো জীবনধারা গঠন। জীবনধারা গঠনের প্রথমেই আসে ব্যক্তি ও সামাজিক জীবন। শিক্ষার মাধ্যমে একজন মানুষকে সঠিক ও প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই হলো ব্যক্তি গঠন। আর এটি শিক্ষার একটি অন্যতম মূল উদ্দেশ্য একজন মানুষকে মার্জিত, ভদ্র, রুচিশীল, কেতাদুরস্ত, বুদ্ধিদীপ্ত, বোধ-বুদ্ধিসম্পন্ন দূরদর্শী, সহমর্মী ও শ্রদ্ধাশীল মানুষ হিসেবে তৈরি করাই ব্যক্তি গঠন। শান্তিপ্রিয়তা, হিতৈষী মনোভাব, গঠনমূলক চিন্তাধারা, কল্যাণকামিতা প্রভৃতি সামাজিক গুণ অর্জন এবং সমাজের প্রতিটি অঙ্গ ও অংশকে বোঝা ও সমন্বয় করে চলাই হলো সামাজিক জীবন। সমাজের মানুষের নিরাপত্তা, অধিকার, স্বাধীনতা, অন্যের প্রতি সম্মান ও মর্যাদাবোধ ইত্যাদি বিষয় অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আত্মকেন্দ্রিকতা সামাজিক জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত ও সঙ্কীর্ণ মনোভাবের সৃষ্টি করে। সঙ্কীর্ণ মনোবৃত্তি জাতিগঠনে পশ্চাৎপদ ধারা তৈরি করে। তা ছাড়া সঙ্কীর্ণতা থেকে নানারূপ অনাচারের সৃষ্টি করে। উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে কেবল এ জায়গটি সংস্কার করা যায়। তাই জাতি গঠনের শিক্ষাব্যবস্থায় গণমুখী ধারা তৈরি করার কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। গণমুখী কর্মব্যবস্থা বা অন্তভর্‚ক্তিমূলক জীবন প্রণালী গঠন তথা সহযোগিতা করা, সহমর্মী হওয়া এবং চিন্তা ও কর্মের ব্যাপক পরিসর তৈরি করাই হলো সংস্কার। এ সংস্কারের জন্য ব্যাপকভাবে সাহিত্য পাঠ ও মূল্যায়নের ব্যবস্থা শিক্ষা কর্মসূচিতে থাকা জরুরি।